লী চ্যাং-ডংঃ খোলা চোখে

নদী দিয়ে কী যেন ভেসে আসে। কাছে আসলে বুঝা যায়, লাশ। একটা মেয়ের লাশ, ছোপছোপ রক্ত মাখা। Poetry(২০১০)-এর শুরুর দৃশ্য।

মিইজাকে আমরা পাই ডাক্তারের চেম্বারে বসা। বয়স কত তার – ষাট, সত্তর? মেয়ের ঘরের নাতিকে নিয়ে একা বাস করে ছোট একটা এপার্টমেন্টে। কয়েকদিন ধরেই হাতটা চিনচিন করছে, ডাক্তারকে জানায় সে। যেন ভেতর দিয়ে…আরে কী যেন শব্দটা…মাথার উপর বাতি-পাখার দিকে তাকায় মিইজা, ওগুলোর ভিতর দিয়ে যায় যে! বিদ্যুৎ! হ্যাঁ, বিদ্যুৎ যেন পেশীগুলোর ভিতর দিয়ে বয়ে যায়।

Poetry

হাসপাতালের বাইরে এলে তার সামনে পরে আহাজারিরত এক মহিলা। সাধারণ মৃত্যু নয় নিশ্চয়, হাসপাতালের সামনে অনেক মানুষের ভিড়। এখনো না জানলেও মিইজা-ও তো জড়িয়ে যাবে এই মৃত্যুর গল্পে। কীভাবে?

সে বরং চিন্তা করে নতুন উদ্ভূত এ সমস্যাটা নিয়ে। হাত দেখাতে এসে মিইজা আবিষ্কার করলো সে শব্দ ভুলতে শুরু করেছে। স্মৃতিও। মাঝে মাঝেই যে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কিন্তু তার না যাওয়ার কথা কমিউনিটি সেন্টারের কবিতার ক্লাসটায়! ক্লাসের প্রথম দিন এসে শহরের বিখ্যাত কবি তার শিক্ষার্থীদের জানায়, কবিতা লিখতে পারে যে কেউ, শুধু চোখ খুলে দেখতে হবে সবকিছু, একেবারে কাছ থেকে। মিইজা প্যাড আর পেন্সিল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন কাব্যিক অনুপ্রেরণার খোঁজে। আর লী চ্যাং-ডং তার পেছন পেছন ক্যামেরা হাতে!

তিনি তো দেখতেই বেরিয়েছেন; মানুষ আর তাদের জীবন; স্বপ্ন, বাস্তবতা, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা। ধর্ম, জাত, শ্রেণি আর সামাজিক ট্যাবু – সবধরনের পক্ষপাতিত্বের চশমা খুলে। পশ্চিমের সিনেমাতে তো এমন গল্প খুঁজে পাওয়া ভার। লী ভেঙ্গেচুরে দেখেছেন আরেকটা জিনিসকে, মৃত্যু, না আরো ভালোমতো বলতে গেলে খুন। Oasis (২০০২), Secret Sunshine (২০০৭),  Poetry (২০১০) – সবগুলোর কাহিনীই তো আবর্তিত একটা খুন নিয়ে। আর সেটার সাথে কীভাবে মানিয়ে নেয় তার আশেপাশের মানুষগুলো।

ওয়েসিসের জং-ডু সদ্য জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আসামী। হিট এন্ড রান। প্রথম দেখাতেই বুঝা যায় জং-ডু ঠিক স্বাভাবিক না। সমাজের সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তার কখনোই ছিলো না। সাধারণ সামাজিকতাগুলো তো তার মাথায় ঢুকে না আর যার কারো মত। হঠাৎ হঠাৎ গিয়ে অপরিচিতদের সাথে আলাপ জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, কেমন কেমন করে তাকায় – জং-ডু সেইসব লোক রাস্তায় দেখলেই যাদের সবাই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।

তার পরিবারও এর ব্যতিক্রম না। জেল থেকে বের হয়ে সে দেখলো তারা আগের বাড়ি পালটে চলে গেছে নতুন কোথাও, তাকে না জানিয়েই। জং-ডু কী করলো? এক ঝুড়ি ফলমূল নিয়ে হাজির হলো তার হাতে মারা যাওয়া সেই ব্যক্তির বাসায়! এটাকে ক্রুর রসিকতার অংশ ভাবলে ভুল হবে। জং-ডুকে দেখে মনে হয় না সেটা করার ক্ষমতা তার আছে। প্রায়শ্চিত্ত? কিন্তু আসলেই তার মাথায় কী খেলে সেটা বুঝাও দুঃসাধ্য!

সেখানে এসে জং-ডু এর সাথে পরিচয় গং-জু এর, মৃতের মেয়ে। সে-ও তো স্বাভাবিক না! সেরেব্রাল প্যালসিতে আক্রান্ত – কথা বলতে পারে না, ঠিকভাবে নড়াচড়াও করতে পারে না। তাকে ফেলে রেখে তার ভাই, বউ-সন্তানসহ জায়গা নিয়েছে নতুন এপার্টমেন্টে। সেখানে তার আশ্রয় ঘটে মাসে একবার, সোশাল সার্ভিসের লোকেরা যেদিন আসে। বাকিটা সময় তো গং-জু এর জীবন আবদ্ধ এই দুই রুমেই, একা একা।

এই জং-ডু তাকে একা পেয়ে ধর্ষণ করলো। কিছু দৃশ্যে কুঁকড়ে যেতে হয়। লী চ্যাং-এর ক্যামেরা চোখ ফেরায় না।  কিন্তু গং-জু আবার তার প্রেমে পড়ে গেলো। দুজনই দুজনের! তাদের জীবনটা যে আর সবার থেকে আলাদা। লী কেবল সেটাতেই দৃষ্টি রেখে বাইরের জগৎটাকে ফোকাসের বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করেছেন। তাই তো বাস্তব লৌকিকতা সাথে মাঝেমাঝেই জং-ডু আর গং-জু এর কল্পনা মিলেমিশে যায়। প্রেম-ভালোবাসা উপস্থিত সেখানে বেশ ভালোভাবেই – বরং বলা যায় একেবারে আদি, অকৃত্রিমতায়। লোক দেখানো সবকিছু বিবর্জিত।

লী এর গল্পের কেন্দ্রে তার চরিত্রগুলোই। আর স্বতঃস্ফূর্ত তাদের বিচরণ। একারণেই তো তার চিত্রনাট্যগুলোকে প্রচলিতের বেড়াজালে আটকানো সম্ভব না। একেবারেই অননুমেয়।

Secret Sunshine এর শুরুটা যেমন সদ্য স্বামী হারানো এক মায়ের সন্তানকে নিয়ে তার স্বামীর বেড়ে ওঠার শহরে ফিরে আসা নিয়ে। এর বেশি আর না জানাই ভালো। Secret Sunshine এর গল্প বদলাবে প্রতি মিনিট বিশেক পরপরই, টোন আর জনরায়ও! শোক  সামলে উঠা, কিংবা শোক সামলে উঠার চেষ্টাকে এত বৈচিত্র্য নিয়ে, গভীরভাবে দেখেছে কিনা আর কোন চলচ্চিত্র আমার জানার ইচ্ছা। শেষ দৃশ্যের পরও হতভম্ব হয়ে বসে থাকতে হয়। তার সমসাময়িকদের মধ্যে তুলনীয় পাশের দেশের কোরে-এদা যেখানে তুমুল সিনিসিজম মাখা চলচ্চিত্রের মাঝেও আশার বাণী শুনিয়ে যান, সেখানে লী এর চলচ্চিত্রগুলো থেকে যেন ঠিকরে বেরোয় রাগ আর ক্ষোভ। কার প্রতি?

তার আগে বরং মিইজার সাথে যোগ দেওয়া যাক কবিতার ক্লাসে। নদীতে ভাসা লাশ, জং ধরতে থাকা স্মৃতি আর সাংবাদিক-পুলিশদের আনাগোনা – যত বাধাই আসুক, চোখ খোলা রেখে দেখতে হবে সবকিছু, কাছ থেকে – কবিতা আছে সবখানেই।

Leave a comment