সূর্যাস্তের আগে

আর সেখানটার পরিত্যক্ত বাড়ির বুক সমান উঁচু পাঁচিলের উপর বসে কলেজপড়ুয়া দুই মোবাইলে তার প্রেমিকার সাথে কথা বলছিল। দুই, যে কিনা আগামী বছর দেশের বাইরে চলে যাবে এবং আরো বেশ কয়েক দশক সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি নিয়ে ভালোভাবেই বেঁচে থাকবে, বলেছিল, “আমি তোমাকে ছাড়া একদিনও বাঁচবো না”। তার প্রেমিকা, যার আগামী বছর অন্য আরেকজনের সাথে বিয়ে হয়ে যাবে এবং সে-ও আরো বেশ কয়েক দশক সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি নিয়ে ভালোভাবেই বেঁচে থাকবে, কাঁদো কাঁদো আবেগঘন কন্ঠে বলেছিল, “আমিও না”।

৬ঃ২০

বাইরে বিকট এক শব্দ হওয়ার সাথে সাথেই কালো হয়ে যাওয়া টেলিভিশনের পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি।  পর্দা টানা ঘরে, বাতি নিভে যাওয়ায় বিকেলে নেমে আসা সূর্যের আলোতেও চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। উপরে ঘুড়তে থাকা পাখার গতি মন্থর হতে হতে থেমে গিয়েছিল, তার শব্দটাও।

বাইরের রাস্তায় মাত্রই স্কুলে ভর্তি হওয়া এক, যে কিনা আর দশ বছর পর এরকম এক বিকেলে, পেছনে ফিরে তার শৈশবের সুখস্মৃতি হাতড়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে এবং ব্যর্থ হবে, তার মায়ের হাত ধরে কোচিং থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। আর তাঁকে বর্ণনা করেছিল কীভাবে আজ স্কুলে টিফিনের সময়ের খেলায় সে সবাইকে হারিয়েছে। তার মা সেকথায় মনোযোগ না দিয়ে বলেছিল, “তাড়াতাড়ি হাঁটো, বৃষ্টি নামবে। বাড়ি ফিরে নাস্তা খেয়ে পড়তে বসবে, আগামী মাসে পরীক্ষা।”

আর তিন রাস্তার মোড়টা পার হওয়ার সময় এক  যখন কাঁতর কন্ঠে জানিয়েছিল আজ সন্ধায় টিভিতে তার প্রিয় অনুষ্ঠান আছে, তখন প্রত্যুত্তরে তার মা হুমকি দিয়েছিল টিভি বাক্সে ভরে গুদাম ঘরে ত্তুলে রাখার।

আর সেখানটার পরিত্যক্ত বাড়ির বুক সমান উঁচু পাঁচিলের উপর বসে কলেজপড়ুয়া দুই  মোবাইলে তার প্রেমিকার সাথে কথা বলছিল। দুই, যে কিনা আগামী বছর দেশের বাইরে চলে যাবে এবং আরো বেশ কয়েক দশক সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি নিয়ে ভালোভাবেই বেঁচে থাকবে, বলেছিল, “আমি তোমাকে ছাড়া একদিনও বাঁচবো না”। তার প্রেমিকা, যার আগামী বছর অন্য আরেকজনের সাথে বিয়ে হয়ে যাবে এবং সে-ও আরো বেশ কয়েক দশক সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি নিয়ে ভালোভাবেই বেঁচে থাকবে, কাঁদো কাঁদো আবেগঘন কন্ঠে বলেছিল, “আমিও না”।

সামনের বড় ছয় তলা বাসার ছাদে তিন  উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে বিকেলের আলোতেও খালিচোখে স্পষ্টভাবে পিপীলিকা নীহারিকা দেখতে পাচ্ছিল। আর মুখ দিয়ে ধোয়া উড়াচ্ছিল মেঘ জমতে থাকা আকাশের দিকে চেয়ে। কারণ সে আর্টপেপারে আকাশের ছবি আঁকতে চায়, পরীক্ষার খাতায় আলোক বিচ্ছুরনের ছবি না।

একই আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়েছিল মধ্যবয়স্ক চার, তার ঘরের জানালা দিয়ে। মাত্র দু’মাস আগেও তীব্র ব্যথা নিয়ে ন’টা-পাঁচটা অফিস করা, আর রাতের বেলা সবার অগোচরে ওষুধ খেয়ে অসুখ দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা, যে এখন শয্যাশায়ী; হার মানা পাকস্থলী নিয়ে।

তার মাথার পাশে বিশালাকার একটা ব্যাং বসে ছিল সৌম্যদৃষ্টি নিয়ে। কানের কাছের রেডিওটায় বিকেলের অনুষ্ঠানের বিরতিতে কোন রবীন্দ্র সংগীত বাজছিল। রক্তহীন ফ্যাকাশে আঙ্গুলগুলো বাতাসে ঢেউয়ের মত নড়ছিল। আর ঝাপসা চোখের সামনে ভাসছিল বিকেলের গুলিস্তানে মানবসমুদ্রের কথা। যেদিক দিয়ে সে প্রতিদিন বাড়ি ফিরতো। যেখানে হকাররা তাদের ওষুধের গাড়ি নিয়ে বসে থাকে আর মাইক বাজিয়ে জানান দেয় তাদের সকল রোগ আরোগ্য করা ওষুধের ক্ষমতা সম্পর্কে। তা যত দুরারোগ্যই হোক না কেন।

আর তার জানলার নিচের মাঠটায় কিশোরদের দল জড়ো হয়ে ছিল পাঁচ-কে ঘিরে। চোখে উৎকন্ঠা আর ভয় নিয়ে। তার পায়ে কাঁচ ঢুকে যাওয়ায় গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছিল। আর অনেক কষ্টে সে কান্না চেপে রেখেছিল। দূরে এক কোনায় থেমে ছিল ফুটবলটা। পুরনো, চামড়া উঠে যাওয়া প্রায়।

মুদিদোকান থেকে সদাই কিনে পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে, হঠাৎ থেমে, সেদিকে তাকিয়ে ছয়-এর  বুকটা কেঁপে ঊঠেছিল। সে যে রক্ত ভয় পায় এজন্য না, বরং বছর দশেক আগের বিকেলগুলোর কথা মনে পড়ায়, আর এখনকার ডোবা হয়ে যাওয়া, তখনকার ঘাসে ঢাকা মাঠটার কথা মনে পড়ায়, আর নিজের অজস্রবার ক্ষতবিক্ষত হওয়া পায়ের কথা মনে পড়ায়, কিন্তু তার চেয়েও বেশি এই উপলব্ধিতে যে, এখন তার ছোটবেলার খেলার সাথীরা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যায় অপরিচিতের মত, সে নিজেও।

আর তার বাবার মুদিদোকানে বসে, গ্রীষ্মের গরমে ঘামতে থাকা হাইস্কুলে পড়া সাত হিসাব মেলাচ্ছিল আজকের বেঁচা-কেনার;দুইদিন পর যেখানে তার বাংলা পরীক্ষা। এরই মধ্যে মনে মনে যোগ-বিয়োগ করার মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যার চোখ পরেছিল সামনের বৈদ্যুতিক খুটির তারে উলটো হয়ে ঝুলে থাকা কাকটার দিকে। আর আশেপাশের সব তারে আর বাসার ছাদে সারি সারি বসে ছিল এলাকার সব কাকেরা। সদ্য প্রয়াত বন্ধুর স্বরনস্বভা পালন করবে বলে, গণসঙ্গীতের মূর্ছনায়।

আর নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়া আট, যে কিনা আগামীকাল হরতালের সময় মারা যাবে, হিসাব মেলাচ্ছিল কীভাবে এর  থেকে নেওয়া ধারের ২০ হাজার টাকা দিয়ে সে তার  থেকে আগের নেওয়া ১০ হাজার টাকার ধার শোধ করে, বকেয়া থাকা ৫ মাসের ভাড়ার অর্ধেক দিয়ে বাড়িওয়ালাকে খুশি করে, বাকি টাকা দিয়ে এমাসের শেষ কয়েকদিনের খরচ চালাবে।

নয়, যে গতকাল মারা গেছে, শুন্যে ভাসতে ভাসতে তার স্কুলফেরত বন্ধুদের অনুসরন করছিল, যারা বন্ধুবিয়োগ শোক দ্রুতই কাটিয়ে বেশ উৎফুল্ল হয়ে বাড়ি ফিরছিল। হয়তো আজকের বিকেলটা খুব সুন্দর বলে। অথবা আসন্ন বৃষ্টির কথা ভেবে। অথবা আগামীকাল কঠিন এক বাড়ির কাজ ছিল, কিন্তু আবার হরতাল ডাকায় তা আর করতে হবে না বলে।

আর টং-এর দোকানে হাইস্কুলের শিক্ষকরা প্রতিদিনকার মত আড্ডা বসিয়েছিল, হাতের চায়ের কাপ নিয়ে, যাতে  চিনি, দুধ, রাজনীতি আর ধর্ম ভালোভাবে মিশানো, আর তারা সেগুলা গলধঃকরন করছিল টোস্ট বিস্কুটের সাথে। সেখানে চা বানাতে বানাতে দশ  তাকিয়ে ছিল ভোকাট্টা হয়ে চক্রাকারে নিচে পরতে থাকা ঘুড়িটার দিকে, যা ধরার চেষ্টায় আর মিনিট খানেক পরেএগার  তিনতলা ছাদের একেবারে কিনারে চলে যাবে এবং জীবনে প্রথমবারের মত উড়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও।

আর পাশের হোটেলটায় বারো  বড় কড়াইয়ে তেল ঢেলে আর উনুনের আগুন বাড়িয়ে প্রস্তুত হচ্ছিল সন্ধ্যার ব্যস্ত সময়টার জন্য। কিন্তু একই সাথে কিছুটা সন্ধিহান ছিল। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে বলে।

আর পাখিরা সব ঘরে ফিরছিল। আর পিপড়ারা সব সারি বেঁধে গর্তে ঢুকে যাচ্ছিল। আর মশারা সব জলা জঙ্গলের ঘর থেকে বেরোচ্ছিল দলে দলে, ভিড় জমাতে শুরু করেছিল কার্বনডাইঅক্সাইডের উৎসগুলোর কাছে। কিন্তু পরিত্যক্ত বাড়িটার পিছের বুক সমান উঁচু ঘাসের আড়ালে পরে থাকা তেরো-’র দেহের সামনে তাদের ভিড় ছিল না খুব একটা। কারণ তার তলপেটের ক্ষতটা থেকে বের হওয়া রক্তের ধারা যতই দীর্ঘতর হচ্ছিল, নিশ্বাসের গতি ততটাই কমে আসছিল। আর সে ব্যথা অনুভব করছিল, প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করছিল, এতটাই যে আশা করছিল যে যদি মারা যায় তবে যেন তা আরো দ্রুততর হয়। আবার একই সাথে আশা করছিল সে যেন বেঁচে থাকে, একসেকেন্ড বেশি হলেও, এবং প্রতিজ্ঞা করেছিল কোন আলৌকিকভাবে যদি আসলেও সে বেঁচে যায়, তবে সে এবার তার জীবন নতুন করে শুরু করবে।
৬ঃ২১

আমি  সোফা থেকে উঠে দরজা খুলেছিলাম বাইরে যাবে বলে, কারণ অনেকদিন ধরে বৃষ্টিতে ভিজি না, আর অনেকদিন ধরে সূর্যাস্ত দেখি না। তখনই হঠাৎ করে সুইচ বন্ধ করা টিভিটা চালু হয়ে গিয়েছিল একাকী-ই। কিন্তু দেওয়ালের বাতি নিভানো ছিল, উপরের পাখা আগের মতই ছিল নিশ্চল। আর সেখানে সূর্যোদয়ের খুব সুন্দর একটা দৃশ্য দেখাচ্ছিল। সেখানে বৃষ্টি পরার ছবি দেখাচ্ছিল। আর আমি  খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, একহাত হাতলের উপর রেখে, সেদিকে ফিরে তাকিয়েছিলাম অনিশ্চয়তা নিয়ে।

Leave a comment